পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠেছে। এখন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরিতেও ভুলভ্রান্তি হচ্ছে। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি, শিক্ষকদের পক্ষ থেকে উত্তর বলে দেওয়া এবং পরীক্ষার আগমুহূর্তে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো এত দিন চার দেয়ালের মধ্যে ঘটে আসছিল। এখন সামাজিক গণমাধ্যমসহ ছাত্রাবাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রশ্নপত্র কেনাবেচা হচ্ছে।
দেশে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা একদিকে বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও। চারটি পাবলিক পরীক্ষায় (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক) প্রায় পৌনে এক কোটি শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। এসব পরীক্ষায় বিভিন্ন ভুলত্রুটি ও অসংগতি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ডগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বিজ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্নও পরীক্ষার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য কেন্দ্রভিত্তিক প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে কীভাবে পরীক্ষা নেওয়া যায়, সে জন্য বিভিন্ন কমিটি করা হয়েছে। এসব কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র ছাপানো যায় কি না, সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রশ্নপত্রে ভুলভ্রান্তি
একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে হইচই চলার মধ্যে চলমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্রে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি ধরা পড়েছে। এর আগে সদ্য শেষ হওয়া জেএসসিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরিতে ভুলভ্রান্তি হয়। প্রশ্নপত্র তৈরি ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলোর বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে।
গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় পরীক্ষার প্রথম প্রশ্নটি বাংলায় ছিল ‘মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে নিচের কোন সমস্যাটি হতো। ইংরেজি ভার্সনে এর অনুবাদ করে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘What would happen if no the Mujibnagar govt. was formed’। একটি প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের ইংরেজি করা হয়েছে ‘ফ্রিডম ফাইট’। আরও বেশ কিছু বাক্যে ও শব্দে ভুল ছিল। এবার সিলেট ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার প্রশ্নপত্রে এই ভুলটি বেশি হয়েছে।
রাজধানীর একটি ইংরেজি ভার্সন স্কুলের দুজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শুধু এবারই নয়, ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্রে ভুল প্রায়ই হয়। যাঁদের দিয়ে এই অনুবাদের কাজটি করা হয়, তাঁরা দক্ষ নন। একই পরীক্ষার বাংলা ভার্সনের একটি প্রশ্ন ছিল ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতির ফলে এ দেশের মানুষের মধ্যে কী সৃষ্টি হয়েছিল। এর চারটি সম্ভাব্য উত্তর ছিল; ১. জাতিগত বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এর উত্তর নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অযোগ্য ব্যক্তিরা শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা হচ্ছেন। ফলে এই সমস্যা হচ্ছে এবং হতেই থাকবে। উত্তরণের জন্য নৈতিকতাসম্পন্ন ও যোগ্য ব্যক্তিদের এসব পদে বসাতে হবে।
প্রাথমিক সমাপনীর প্রশ্নপত্র তৈরি করে ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)। আট সেট প্রশ্ন ছাপিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়। অনুবাদ করেন শিক্ষা কর্মকর্তারা। সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এটা সত্যি যে এবার বড় ধরনের ভুল হয়ে গেছে, কিন্তু প্রশ্নপত্র তাঁরা দেখতে পারেন না। এখন তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সদ্য শেষ হওয়া জেএসসির গার্হস্থ্যবিজ্ঞান বিষয়ের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্রেও বেশ কিছু ভুল ছিল। গত বছরের এসএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে গণিতের প্রশ্নে ১১টি, ঢাকা বোর্ডে পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নে ৫টি, রাজশাহী বোর্ডে বাংলা প্রথম পত্রে ৩টি এবং দ্বিতীয় পত্রে ৪টি ভুল পাওয়া যায়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বোর্ডে গণিতের প্রশ্নে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলিয়ে ১১টি ভুল হয়েছিল। ওই সময় ভুলের পাশাপাশি বেশ কিছু এলাকায় দুই বছর আগের প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এর আগে ২০১২ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, কুড়িগ্রাম ও হবিগঞ্জ জেলায় এসএসসি পরীক্ষায় ভুল করে এক বছরের প্রশ্নে আরেক বছরের পরীক্ষা নেওয়া হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, ভুলভ্রান্তিতে জড়িতদের কালো তালিকাভুক্ত করাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
শুধু পরীক্ষার দিন নয়, আগেও প্রশ্নপত্র ফাঁস
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুধু পরীক্ষার দিনে সকালেই নয়, পরীক্ষা শুরুর এক-দুই দিন আগেও হুবহু প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। বিজি প্রেস ও পরীক্ষাকেন্দ্রের পাশাপাশি বিতরণ পর্যায়েও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। আগে বিভিন্ন সময়ে একটি-দুটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও ২০১২ সালের পর থেকে প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। সদ্য শেষ হওয়া জেএসসি পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।
অনুসন্ধানকালে কথা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (পশ্চিম বিভাগ) এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৭ মার্চ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আশুলিয়ার গাজীরচট এ এম উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোজাফফর হোসেনসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্তের সময় জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানান, গত এসএসসি পরীক্ষার সময় কেন্দ্রসচিব হিসেবে ওই অধ্যক্ষ তাঁর এক অফিস সহকারীকে নিয়ে পরীক্ষার দিন সকালে সাভার মডেল থানায় প্রশ্নপত্র আনতে যেতেন। ওই সময় প্রশ্নপত্র বণ্টনের দায়িত্বে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন সাভার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (বর্তমানে অন্যত্র বদলি)। পুলিশ জানতে পারে, সেখানে যোগসাজশ ও কৌশলে ওই অধ্যক্ষ এবং তাঁর অফিস সহকারী যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা হতো, সেই বিষয়ের প্রশ্নপত্রের পাশাপাশি পরবর্তী দিনের দু-একটি প্রশ্নপত্র কৌশলে নিয়ে আসতেন। পরে হাত ঘুরে তা ছড়িয়ে যায়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ফেসবুক আইডি থেকেও কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নমুনা পরীক্ষার আগের রাতে পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রশ্নপত্র প্রণয়নে অনেক সময় একই শিক্ষককে একাধিক বছরের প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে এই শিক্ষক বা অন্যরা নিজ স্কুল ও কোচিং সেন্টারে সাজেশন হিসেবে প্রশ্নগুলো বলে দেয় বলে অভিযোগ আছে। আবার যখন বিজি প্রেসে ছাপার আগে প্রশ্ন কম্পোজ করা হয়, তখনো প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ থাকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বীকার করেন, ঢাকা বোর্ডের অধীনে গত এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নির্ধারিত ‘সেট’ আগের দিন রাতেই ফাঁস হয়ে যায়। বিষয়টি জানতে পেরে ভোর রাতে সেট পরিবর্তন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়।
এর আগে ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ও গণিতের প্রশ্নপত্রও পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হয়। ২০১৫ সাল থেকে পাবলিক পরীক্ষায় কিছু শিক্ষক পরীক্ষা শুরুর এক-দুই ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্রের সিলগালা প্যাকেট খুলে মুঠোফোনে ছবি তুলে তা বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সদ্য শেষ হওয়া জেএসসি পরীক্ষায় দেখা গেছে, বহু নির্বাচনী অংশের (এমসিকিউ) পরীক্ষায়ও এ ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও কিছু কিছু প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেগুলো ছিল সীমিত। সম্প্রতি এটা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে মেধাবী ছাত্রটি যখন দেখে, তার চেয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকা ছাত্রটি পরীক্ষায় ভালো ফল করে এগিয়ে যাচ্ছে, ওই মেধাবী ছাত্র তখন হতাশ হয়ে যায়। এতে একধরনের আস্থাহীনতায় বড় হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এটা শিক্ষার গুণগত মানের ওপর প্রভাব ফেলছে।
অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জাতীয় সংসদে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন, এখন শিক্ষক নামধারী কিছু দুষ্কৃতকারী পরীক্ষার দিন কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সেটাও নজরদারিতে আছে, ধরা হচ্ছে। কাউকে ছাড়া হবে না।
অভিন্ন প্রশ্নপত্রে বুমেরাংয়ের আশঙ্কা
প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী বছরের পাবলিক পরীক্ষা থেকে পরীক্ষার দিন সকালে স্থানীয়ভাবে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে পরীক্ষার নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও তা আপাতত হচ্ছে না।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। এবারও আগের মতোই বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এ ছাড়া আসন্ন পরীক্ষা থেকে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হবে।
কয়েকটি শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এতে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, এক জায়গায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।
সূত্র:প্রথম আলো
Leave a comment
You must be logged in to post a comment.